দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা । দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।

 দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি


ভূমিকা


আধুনিককালে পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট । আইনসভার কয়টি কক্ষ থাকা উচিত এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে । দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে এবং এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মতামত দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল , লেকি ,হেনরি মেইন ,গেটেল ,লর্ড অ্যাকটন  এবং দ্যুগুই । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ব্রিটেন,  ফ্রান্স,  জার্মানি,  জাপান,  রাশিয়া ভারত , সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি  রাষ্ট্র দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।



পক্ষে যুক্তি



(১) সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন: আইন সভার একটি কক্ষ থাকলে অনেক ক্ষেত্রে সময়ের অভাবে দ্রুত আইন প্রণয়ন করতে হয় ।  ফলে আইনে ভুল ত্রুটি থেকে যেতে পারে। কিন্তু আইনসভার  দ্বিতীয় কক্ষ থাকলে সুচিন্তিতভাবে বিচার বিবেচনা করার ফলে আইনের কোনো দোষ ত্রুটি থাকতে পারে না । এর ফলে উন্নত আইন প্রণয়ন সম্ভব হয়।


(২) সহায়ক ভূমিকা : আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারের কাজ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে । আইনসভার একটিমাত্র কক্ষের দ্বারা বৃহত্তম দেশের জন্য আইন সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না । যদি  আইনসভার দুটি কক্ষ থাকে তাহলে বিল গুলিকে আরো বিচার বিবেচনার জন্য সময় পাওয়া যায় ।


(৩) একমাত্র কক্ষের স্বৈরাচারী রোধ :

লর্ড অ্যাকটনের  মতনুসারে, দ্বিতীয় পরিষদ হল স্বাধীনতার একটি  অপরিহার্য নিরাপত্তা( A second chamber is the essential security for freedom)। একটিমাত্র পরিষদ নিয়ে আইনসভা গঠিত হলে তা স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।  কারণ এই পরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় থাকে না  । কিন্তু দ্বিতীয় পরিষদের উপস্থিতি প্রথম পরিষদের স্বৈরাচার করতে পারে । সেজন্য বলা যায় যে , উচ্চ পরিষদ নিম্নপরিষদের অত্যাচার থেকে জনসাধারণের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করে।


(৪) উচ্চকক্ষে বিচক্ষণ ব্যক্তিরা নিয়োগ : আইনসভায় জ্ঞানী, গুণী অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা যত বেশি থাকবেন আইনসভার উৎকর্ষ তত বৃদ্ধি পাবে।  এভাবে দেশ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারা সেরা লাভ করতে পারে। 


(৫) সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা : আইনসভায় সংখ্যালঘু স্বার্থের যথাপোযুক্ত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা না থাকলে গণতন্ত্রের সাফল্য আসতে পারে না । তাই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষ সাধারণত মনোনয়ন বা পরোক্ষ নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত হয় বলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর অনেক প্রতিনিধি সেখানে স্থান পান । ওইসব প্রতিনিধি নিজ নিজ  সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার উপযোগী আইন  যাতে প্রণীত হয় , সেজন্য বিশেষভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাই দ্যুগুই   মন্তব্য করেছেন যে,  সেই আইনসভা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে, যার এক কক্ষ সমগ্র জনগণের এবং অন্য কক্ষ বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।


(৬) রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার দুটি কক্ষে আইন প্রণয়নের সময় আলাপ-আলোচনা ও তর্কবিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় । অনেক সময় আইনসভার উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ পরস্পর বিরোধী দুটি রাজনৈতিক দল বা মোর্চার প্রতিনিধিরা থাকেন বলে যেকোনো বিষয়ে আইন প্রণয়নের সময় তাঁদের  মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ চলতে থাকে । এইসব সংবাদ সংবাদপত্র, বেতার , দূরদর্শন প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচারিত হয় । ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে।


(৭) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে অপরিহার্য : জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে । দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আঞ্চলিক স্বার্থের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয় বলে তা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে বিশেষ উপযোগী বলে বিবেচিত হয় । এরূপ আইনসভার নিম্নকক্ষের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জাতীয় স্বার্থ এবং উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিবৃন্দ  আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন । তাই এরূপ আইনসভাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে অপরিহার্য বলে অনেকে মনে করা হয় ।


(৮) সুশাসন প্রবর্তন :গেটেলের মতে,  আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে উভয় কক্ষই একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার  শাসন বিভাগের ওপর আইন বিভাগের মাত্রাতিক্ত নিয়ন্ত্রণ না থাকায় শাসন বিভাগ স্বাধীনভাবে কার্যসম্পাদনের দ্বারা সুশাসন প্রবর্তন করতে পারে।




বিপক্ষে যুক্তি



(১)অগণতান্ত্রিক : দ্বিতীয় কক্ষের গঠন  অগণতান্ত্রিক । গণতন্ত্র যেহেতু জনগণের দ্বারা , জনগণের জন্য , জনগণের শাসন, সেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয় । কিন্তু দ্বিতীয় কক্ষের  সদস্যরা সকলে  মনোনীত হন।


(২) ব্যয়বহুল: দ্বিতীয় কক্ষ থাকলে তার জন্য রাষ্ট্রের অনেক ব্যয় হয়  । এই অপচয় বন্ধ করে সেই অর্থ দিয়ে জনকল্যাণমূলক কাজ করা যেতে পারে। 


(৩) সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব : এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা যদি মনোযোগ সহকারে আইন প্রণয়ন করে তবে দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজন হয় না । অনেক সময় দ্বিতীয় কক্ষ অযথা আইনটিকে আটকে রাখে। 


(৪) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে অপরিহার্য নয় : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা সাফল্যের জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা অপরিহার্য নয় । কারণ সংবিধান অনুসারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গুলির মধ্যে ক্ষমতা বন্টন এর মাধ্যমে আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।  অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে , যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উচ্চকক্ষ অপরিহার্য নয়, এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা সকলের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। 


(৫) সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষার জন্য আবশ্যিক নয় : সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গুলির স্বার্থ রক্ষার জন্য আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজন বলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সমর্থক ও প্রবর্তক মনে করেন । কিন্তু এরূপ বক্তব্যকে যথার্থ বলে মেনে নেওয়া যায় না । কারণ সংবিধানে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির স্বার্থ সর্বপেক্ষা বেশি রক্ষিত হতে পারে।


(৬) জ্ঞানীগুণীরা স্থান পান না : গণতন্ত্র দলীয় শাসন হওয়ায় আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষের সদস্যদের মনোনয়ন বা পরোক্ষ নির্বাচনে দলীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য লাভ করে । নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের লোকেরাই দ্বিতীয় কাক্ষে  স্থান পান ।  তাই অধিকাংশ সময় প্রকৃত যোগ্য এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা দ্বিতীয় কক্ষে মনোনীত হতে পারেন না । 



মূল্যায়ন 

 সমালোচনা ও প্রতি সমালোচনা যাই হোক না কেন , সম্প্রতিককালে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দিকে ঝোঁক দেখা যাচ্ছে । চীনবাদে বিশ্বের অনেক দেশেই এক কক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ গঠিত হয়েছে । এতে খরচ অনেক কম ,দ্বিকক্ষের জন্য ব্যায়িত  অর্থ দিয়ে

 জনগণের অনেক কাজ করা যেতে পারে । অধ্যাপক গেটেল দ্বিকক্ষ ব্যবস্থাকে  ' রাজনৈতিক বিকাশের একটি রূপান্তর কালীন পর্যায় '(A transitional stage in political development)  বলে অভিহিত করেছেন। 







Post a Comment

Previous Post Next Post