লোকসভার অধ্যক্ষ । লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা , কার্যাবলী,ও পদমর্যাদা । ভারতের লোকসভার স্পিকার - Political Science Notes Online

 ভারতের লোকসভার অধ্যক্ষ বা স্পিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করো ।


                 অথবা 


লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা , কার্যাবলী ও পদমর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করো।


                 অথবা 


লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।






লোকসভার অধ্যক্ষ


 ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সংসদের পদাধিকারীদের মধ্যে লোকসভার স্পিকারের পদ হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । তিনি লোকসভার প্রথম ও প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হন । ব্রিটেনের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অনুকরণে ভারতের শাসন ব্যবস্থার রূপরেখা রচিত হয়েছে ।  ব্রিটিশ কমন্স সভার স্পিকার এর অনুকরণে ভারতের লোকসভার সভাপতি কে অধ্যক্ষ বা স্পিকার বলা হয়।


স্পিকারের নির্বাচন : স্পিকারের নিয়োগ, ক্ষমতা ও কার্যাবলী সংবিধানের বিভিন্ন ধারা সুষ্ঠুভাবে উল্লেখ আছে । ভারতীয় সংবিধানের 93 নম্বর ধারা অনুসারে , নবনির্বাচিত লোকসভার প্রথম অধিবেশনেই লোকসভার সদস্যগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ (Speaker) এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ (Deputy Speaker) হিসেবে নির্বাচন করেন। ব্রিটেনে স্পিকারের নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজা বা রানীর অনুমোদন থাকে । কিন্তু ভারতে স্পিকারের নির্বাচনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগে না। স্পিকারের নির্বাচনকে সর্বসম্মত করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করার পর স্পিকার পদের প্রার্থী মনোনীত করে।


স্পিকার পদের যোগ্যতা : সংবিধানের নির্দেশ অনুযায়ী অধ্যক্ষকে লোকসভার সদস্য হতে হয় । সুতরাং লোকসভার সদস্য হতে গেলে যেসব যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন অধ্যক্ষকে ও সেইসব যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়।


স্পিকারের কার্যকাল ও পদচ্যুতি :  স্পিকারের কার্যকাল সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা হয়নি।  তবে লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ যতদিন থাকে অধ্যক্ষ ততদিন স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন । বর্তমানে অধ্যক্ষ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন । অবশ্য তিনি নিজে পদত্যাগ করলে কিংবা তাকে পদচ্যুত করা হলে অথবা কোনো কারণে তাঁর লোকসভার সদস্য পদ বাতিল হয়ে গেলে বা তাঁর মৃত্যু ঘটলে কার্যকাল পরিসমাপ্তির পূর্বেই অধ্যক্ষের পদ শূন্য হতে পারে । লোকসভার মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অধ্যক্ষকে অপসারণ করার জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য । অবশ্য এরূপ প্রস্তাব লোকসভায়  উত্থাপন করার জন্য 14 দিনের নোটিশ দিতে হয় । অধ্যক্ষের অপসারণ সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব আলোচনার সময় তিনি সভার কার্য পরিচালনা করতে পারেন না । তবে সভায় আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা ভাষণদানের তাঁর ক্ষমতা রয়েছে।


স্পিকারের বেতন : বর্তমানে অধ্যক্ষ মাসিক 1 লক্ষ 25 হাজার টাকা বেতন ছাড়াও পেনশন, নানারকম ভাতা ও বিনা ভাড়ায় বাসস্থান পান । পার্লামেন্ট তাঁর বেতন ভাতা ইত্যাদি নির্ধারণ করতে পারলেও এইসব ব্যয় পার্লামেন্টের অনুমোদনসাপেক্ষে নয় । ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে অধ্যক্ষের বেতন , ভাতা ইত্যাদি প্রদান করা হয়।



স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী 


(১) প্রশাসনিক কার্য : লোকসভার অধ্যক্ষের প্রশাসনিক কার্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।  সভায় কোন কোন প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে , কী ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন সংশোধনী প্রস্তাব বৈধ কি না, কোন কোন নোটিশ আলোচনার জন্য গৃহীত হবে ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় । লোকসভার কোন সদস্য সভার কার্য পদ্ধতি সম্পর্কিত কোনো নিয়ম-কানুন এর যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য অধ্যক্ষ কে অনুরোধ করলে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের অভিমত জ্ঞাপন করেন। অধ্যক্ষের যেকোনো সিদ্ধান্তকে আদালতের ‌ এক্তিয়ারের  বাইরে রাখা হয়েছে । অর্থাৎ অধ্যক্ষের কোনো সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না।



(২) লোকসভার বিতর্ক ও আলোচনা নিয়ন্ত্রণ : লোকসভার অধিবেশনে অধ্যক্ষ নিজে বিতর্ক বা  ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন না । কিন্তু প্রস্তাবের পক্ষে এবং বিপক্ষে যদি সমান ভোট পড়ে তাহলে তিনি 101 নম্বর ধারা অনুসারে একটি নির্ণয়ক ভোট দিয়ে অচলাবস্থার অবসান ঘটান।


(৩) সভার শৃঙ্খলা ও মর্যাদা রক্ষা : কোনো বিষয়ে সভার দৃষ্টি আকর্ষণ বা বক্তৃতা দানের জন্য যেকোনো সদস্যকে অনুমতি নিতে হয় । লোকসভায়  শৃঙ্খলা বিরুদ্ধ আচরণের জন্য তিনি যেকোনো সদস্যকে বহিষ্কার করতে পারেন । সভার আলোচনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তিনি সভার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে পারেন । সংবিধানের 122 নম্বর ধারা অনুসারে, স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে আদালতে যাওয়া যায় না।


(৪) অর্থ বিল সংক্রান্ত ক্ষমতা : অর্থবিলের ব্যাপারে স্পিকারের কিছু  বিশেষ ক্ষমতা আছে । কোনো বিল অর্থবিল কি না , এই বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে স্পিকার মীমাংসা করেন । এক্ষেত্রে স্পিকারের সিদ্ধান্তই হলো  চুড়ান্ত ।  তা ছাড়া লোকসভায় গৃহীত হওয়ার পর অর্থবিলকে রাজ্যসভা বা  রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় , তখন বিলটি যে একটি অর্থবিল সে বিষয়ে স্পিকারকে একটি প্রমাণপত্র(Certificate) দিতে হয়।


(৫) যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব : কোনো সাধারণ বিলের ব্যাপারে লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে যদি মতপার্থক্য দেখা , দেয় তা হলে তার মীমাংসার জন্য রাষ্ট্রপতি  উভয় কক্ষের যুগ্ম অধিবেশন আহ্বান করেন । এই যুগ্ম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার [118(1) ধারা ]।


(৬) রাষ্ট্রপতি ও পার্লামেন্টের মধ্যে যোগসূত্র : রাষ্ট্রপতি ও পার্লামেন্টের মধ্যে স্পিকার যোগসুত্র হিসেবে কাজ করেন । রাষ্ট্রপতি স্পিকারের মাধ্যমে তাঁর বার্তা, বাণী ও বক্তব্য পার্লামেন্টে উপস্থাপিত করেন । স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের কাছে এবং পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতির কাছে যাবতীয় বক্তব্য পেশ করেন।  সুতরাং স্পিকার হলেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পার্লামেন্টের যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে।


(৭) লোকসভার সদস্যদের অধিকার রক্ষা : লোকসভার সদস্যদের বিশেষ অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব অধ্যক্ষকে পালন করতে হয় । সভার কোনো সদস্য কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি সদস্যদের আইনভঙ্গ কিংবা সভার অবমাননা করলে লোকসভার পক্ষে তিনি সংশ্লিষ্ট সদস্য বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন । সভার অবমাননার জন্য কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলে সবার অধিবেশনের পরিসমাপ্তি ঘটে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মুক্তিলাভ করেন।


(৮) লোকসভার কমিটি সম্পর্কিত ক্ষমতা : বিভিন্ন দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য লোকসভা কতগুলি কমিটি গঠন করে । স্পিকার এই কমিটিগুলির  গঠন তত্ত্বাবধান করেন । তিনি বিভিন্ন কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করেন । এই কমিটিগুলি নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণাধীনে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পাদন করে।


(৯) কোরাম সম্পর্কিত ক্ষমতা : লোকসভায় যদি আবশ্যিক সর্বনিম্ন নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য উপস্থিত না থাকেন, অর্থাৎ কোরাম না হয় , তাহলে তিনি সবার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখেন।


(১০) গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ক্ষমতা : অধ্যক্ষের সম্মতি ছাড়া লোকসভার কোনো সদস্যকে পার্লামেন্টের চত্বরের মধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেন।


(১১) অন্যান্য ক্ষমতা:

(ক) স্পিকার লোকসভার সচিবালয়ের প্রধান দায়িত্ব পালন করেন ।

(খ) স্পিকার রাজ্য আইনসভা গুলির সভাপতিদের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করে থাকেন।

(গ) দলত্যাগ বিরোধী আইনের ভিত্তিতে তিনি লোকসভার সদস্যদের অপসারণ করতে পারেন ।


পদমর্যাদা


 ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় জনপ্রিয় কক্ষের সভাপতি হলেন স্পীকার । এ দিক থেকে তাঁর পদ অত্যন্ত মর্যাদাযুক্ত এবং তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ । ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্পীকারের পদটি অতিমাত্রায় দায়িত্বযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ । লােকসভার সম্ভ্রম ও স্বাধীনতার প্রতীক হলেন স্পীকার । এই সভার সভাপতি হিসাবে স্পীকার হলেন সমগ্র জাতির স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক । লােকসভার সম্মান , স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব স্পীকারের উপরই ন্যস্ত থাকে । স্পীকার হলেন এই জনপ্রিয় কক্ষের স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতীক । গণপরিষদে স্পিকার প্রসঙ্গে  জওহরলাল নেহরু ( Nehru ) মন্তব্য করেছেন –– " The Speaker represents the House . He represents dignity of the House , the freedom of the House and because the House represents the nation in a particular way , the Speaker becomes the symbol of the nation’s freedom and liberty . ” সর্বভারতীয় ভিত্তিতে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে লােকসভা গঠিত হয় । এই লােকসভার সভাপতি হিসাবে স্পীকারের পদ জাতীয় মর্যাদাযুক্ত ।

https://politicalsciencenotesonline.blogspot.com



Post a Comment

Previous Post Next Post