রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ঐশ্বরিক মতবাদটি সমালোচনা-সহ আলোচনা করো ।
অথবা
ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ সম্পর্কে আলোচনা করো।
ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ ( Theory of Divine Origin)
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সব থেকে প্রাচীন মতবাদ হলো ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ । ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ হল একটি কল্পনাপ্রসূত মতবাদ । এই মতবাদ অনুসারে পৃথিবীতে রাষ্ট্র হলো ঈশ্বরের সৃষ্টি । ' ঈশ্বর স্বয়ং রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন ’- এই হল এই মতবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। সেন্ট অগাষ্টাইন ,সেন্ট পল , রবার্ট ফিলমার প্রমুখ এই মতবাদের প্রচারক ।
মুল কথা
এই মতবাদের মূল কথা হলো –
ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ অনুসারে রাষ্ট্র ইশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে । রাষ্ট্র ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত হয় । এ জগতে রাজাই হলেন ঈশ্বরের মনােনীত প্রতিনিধি । ইশ্বরের ইচ্ছা প্রকাশিত হয় তার প্রতিনিধির মাধ্যমে অর্থাৎ রাজার আদেশই হল ঈশ্বরের নির্দেশ । তাই জনগণের কর্তব্য হল দ্বিধাহীন ও প্রশ্নাতীতভাবে রাজার আদেশ মেনে চলা । রাজার আদেশ অমান্য করার অর্থ হল ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করা বা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরােধিতা করা । সুতরাং রাজদ্রোহিতা ধর্মদ্রোহিতার সামিল । রাজার কথাই হল আইন । তাঁর যাবতীয় কার্যকলাপ কল্যাণকর এবং ন্যায়সঙ্গত । রাজা হলেন ঈশ্বরের একমাত্র প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি । তাই তার যাবতীয় দায় - দায়িত্ব ঈশ্বরের কাছে । প্রজাসাধারণের কাছে তাঁর কোন দায় দায়িত্ব নেই । প্রজাদের কাছে জবাবদিহি করতে তিনি বাধ্য নন । অর্থাৎ এই দুনিয়ার কোন কিছু বা কারাের দ্বারাই তার ইচ্ছা - অনিচ্ছা ও ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয় । রাজপদ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করা যায় রাজার মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজপদে অভিষিক্ত হবেন এটিই হল ঈশ্বরের বিধান । সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যার ধর্ম । তাই তাঁর কর্তব্য হলো দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। এই মতবাদে রাজাকে প্রজাসাধারণ ও আইনের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে । এইভাবে রাজাকে সর্বময় কর্তৃত্বসম্পন্ন করা হয়েছে, এই মতবাদে ।
বৈশিষ্ট্য
এই মতবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল–
( ১ ) পৃথিবীতে রাষ্ট্র হল ঈশ্বরের সৃষ্টি ।
( ২ ) পৃথিবীতে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি । প্রজাপালনের দায়িত্ব দিয়ে ঈশ্বর তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ।
( ৩ ) রাজার আদেশই হল ঈশ্বরের নির্দেশ । রাজার আদেশই হল আইন এবং এই আইন হল চূড়ান্ত ।
( ৪ ) রাজা তাঁর কাজকর্মের জন্য প্রজাসাধারণের কাছে দায়ী নন । তার দায় - দায়িত্ব ঈশ্বরের কাছে ।
( ৫ ) রাজদ্রোহিতা ধর্মদ্রোহিতার সামিল । প্রজাসাধারণ রাজার কাজকর্মের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুলতে পারে না।
( ৬ ) ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ চরম রাজতন্ত্রের জন্ম দেয় ।
সমালোচনা
১ ) অনৈতিহাসিক : ঈশ্বর রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন এবং রাজা হলেন তার প্রতিনিধি ’ — এই হল ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের মূল বক্তব্য । কিন্তু এই বক্তব্যের সমর্থনে কোন ঐতিহাসিক নজির পাওয়া যায় না । এই কারণে মতবাদটি অনৈতিহাসিক । রাষ্ট্র হল একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান । মানুষের প্রয়ােজনেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে । রাষ্ট্র সৃষ্টির কোন লিখিত ইতিহাস নেই ।
( ২ ) অযৌক্তিক : ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ অযৌক্তিক । ঈশ্বর মঙ্গলময় ও করুণাময় । তিনি তাঁর সৃষ্ট জীবের প্রতি নির্দয় হতে পারেন না । রাজা যদি ঈশ্বরের প্রতিনিধি হন , তবে তিনিও নিশ্চয়ই প্রজাবৎসল ও সুশাসক হবেন । কোনো প্রজাপীড়ক এবং অত্যাচারী রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নেওয়া যায় না । বাস্তবে কিন্তু স্বৈরাচারী রাজার সংখ্যাই বেশী ছিল।
( ৩) স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন : এই মতবাদটি স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করে । রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি । তাই রাজার আদেশ এবং আইনকানুন সমালােচনার উর্ধ্বে । এর ফলে স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত হয় । মতবাদটি রাজাকে করেছে অবাধ , অসীম ও চূড়ান্ত ক্ষমতার আধার । তাঁর আদেশই হল অমােঘ আইন । আবার রাজা হলেন সব রকম দায় - দায়িত্বের উর্ধ্বে । তার কার্যকলাপের জন্য রাজা কারও কাছে দায়ী নন । অর্থাৎ মতবাদটি রাজার দায়িত্বহীনতা এবং স্বৈরাচারিতার পথকে প্রশস্ত করে । এই কারণে মতবাদটি অগণতান্ত্রিক এবং সমর্থনের অযােগ্য ।
( ৪ ) অসম্পূর্ণ: এই মতবাদে একমাত্র রাজতন্ত্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । মতবাদটি কেবল রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করে । কিন্তু বর্তমান গণতন্ত্রের যুগে রাজতন্ত্র ক্রমশ অবলুপ্তির পথে । তাছাড়া গণতান্ত্রিক , প্রজাতান্ত্রিক , সমাজতান্ত্রিক বা অন্য কোন ধরনের শাসনব্যবস্থার উৎপত্তি বিষয়ক কোন আলােচনা এই মতবাদের সাহায্যে করা যায় না । তাই মতবাদটি অসম্পূর্ণ ।
(৫) লৌকিক বিষয়ে ঈশ্বরের কল্পনা ভ্রান্ত : ঈশ্বরের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কেবল ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে । প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ কষ্টকল্পনা মাত্র । এই কারণে অনেক ধর্মযাজকও ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ কে সমর্থন করেননি।
(৬) নাস্তিকদের অনুগত্যহীনতা : যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী তারা রাষ্ট্রকে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মেনে নিয়ে অনুগত্য প্রদর্শন করতে পারে কিন্তু যারা নাস্তিক তাঁরা এই যুক্তিতে রাষ্ট্র বা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে না । ফলে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
উপসংহার
রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা হিসেবে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদকে নানা দিক থেকে সমালোচনা করা হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কে কোনোমতেই অস্বীকার বা উপেক্ষা করা যায় না। অধ্যাপক গেটেল বলেছেন – "মানুষ যখন স্বায়ত্তশাসনের জন্য উপযুক্ত ছিল না তখন এই মতবাদ মানুষকে অনুগত্যের শিক্ষা দান করেছিল"। তা ছাড়া রাষ্ট্রের উৎপত্তির পেছনে অনান্য উপাদান গুলোর পাশাপাশি যে ধর্মের গুরুত্ব আছে তা এই মতবাদ স্বীকার করেছে।
Post a Comment