ভারতের সুপ্রিমকোর্টের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো।ভারতের সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী:(Powers and functions of the Supreme Court of India).


ভূমিকা


 ভারতীয় বিচারব্যবস্থার গঠন ঠিক মিশরের পিরামিডের মতো। ভারতের অখন্ড বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান। ভারতীয় সংবিধানের 124 থেকে 147 নং ধারাগুলিতে সুপ্রিমকোর্ট সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ভারত শাসন আইন অনুসারে 1935 সালে ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় । 1950 সালে এই ফেডারেল কোর্ট সুপ্রিম কোর্ট নামে ভারতের সংবিধানে পরিচিতি লাভ করে।  এই আদালত ভারতের সর্বোচ্চ আদালত । তবে পূর্বতন ফেডারেল কোর্ট অপেক্ষা বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট অনেক বেশি ক্ষমতা ভোগ করে।


গঠন


 ভারতীয় সংবিধান অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষমতা ভারতের পার্লামেন্টের ওপর ন্যস্ত আছে । মূল সংবিধানে 124 নং ধারায় বলার ছিল 7 জন বিচারপতিসহ একজন প্রধান বিচারক থাকবেন । তবে সংসদ প্রয়োজনমতো বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবে । বর্তমানে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিমকোর্টের বিচারকের সংখ্যা 34 জন।  এছাড়াও আরো দুই ধরনের বিচারক যথা সামরিক এবং অস্থায়ী বিচারক সুপ্রিমকোর্টে দেখা যায় । ভারতের সংবিধানের 127 নং ধারায় বলা আছে যে সুপ্রিম কোর্টের সভায় কাজ চালানোর মত বিচারক উপস্থিত না থাকলে  সাময়িক বিচারপতি নিযুক্ত হতে পারেন।


বিচারপতিদের যোগ্যতা 


সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হতে গেলে একজন ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিক এবং কম পক্ষে পাঁচ বছর কোনো হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে অথবা অন্তত দশ বছর একাদিক্রমে কোনো হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করতে হবে , কিংবা রাষ্ট্রপতির মতে তাঁকে  একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ হতে হবে । [ 124(3)নং ধারা ]



বিচারপতিদের নিয়োগ


 সুপ্রিমকোর্টের প্রত্যেক বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন । তবে এরূপ নিয়োগের পূর্বে সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টের  যেসব বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন বলে রাষ্ট্রপতি মনে করেন , তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করার পরই তিনি এরূপ নিয়োগ করে থাকেন । কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের পূর্বে রাষ্ট্রপতি কে ভারতের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করতে হবে ।[ 124 (2)নং ধারা]


বিচারপতিদের কার্যকালের মেয়াদ ও অপসারণ


 সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা 65 বছর বয়স পর্যন্ত নিজেদের পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন। অবশ্য বিচারপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে অথবা মৃত্যু হলে কিংবা তাকে পদচ্যুত করা হলে কার্যকাল পরিসমাপ্তির পূর্বেই বিচারপতির পদ শূন্য হতে পারে । কেবল প্রমাণিত অসদাচরণ কিংবা অসমর্থ ছাড়া অন্য কোন কারণে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারপতি কে পদচ্যুত করা যায় না।


কার্যাবলী


 সুপ্রিমকোর্টের কার্যাবলী কে চার ভাগে ভাগ করা যায় যথা- মূল এলাকা ,আপিল এলাকা ,পরামর্শদান এলাকা ,আদেশ-নির্দেশ ও লেখ জারি এলাকা এছাড়া সুপ্রিমকোর্ট Court of Record  হিসেবে কাজ করে । পার্লামেন্ট আইন করে সুপ্রিম কোর্টকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিতে পারে।[138(1) ধারা ]



মূল এলাকা 


যে সমস্ত মামলা একমাত্র সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা যায় এবং একমাত্র সুপ্রিম কোর্টে যে সমস্ত মামলার নিষ্পত্তি করতে পারে সেই ক্ষেত্রগুলি মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত । যেমন- ১) কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের বিরোধ  ,২) কেন্দ্রীয় সরকার এবং এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের সঙ্গে অন্য এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের বিরোধ, ৩) দুই বা ততোধিক রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধ।


আপিল এলাকা 


নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যায়। আপিল চার প্রকার ক) সংবিধান সংক্রান্ত আপিল[132(1)ধারা], খ) দেওয়ানি আপিল [133(1)ধারা ], গ) ফৌজদারি আপিল[134(1)(2)ধারা], ঘ) বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল[136(1)ধারা]।


ক) সংবিধান সংক্রান্ত আপিল 

 এমন কোনো মামলা যে মামলাটি সংবিধানের ব্যখ্যা সঙ্গে জরিত আছে তাহলে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যাবে তবে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে।


খ) দেওয়ানি আপিল

কোনো দেওয়ানি মামলার সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ আইনের বিষয় যুক্ত থাকলে এবং হাইকোর্ট অনুমতি দিলে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। 


গ) ফৌজদারি আপিল

ফৌজদারি মামলাতে, নিম্নবর্তী আদালতে  কোনো  ব্যক্তি নির্দোষ বলে প্রমানিত হলে কিন্তু ওই ব্যক্তিকে হাইকোর্ট মৃত্যদন্ড দিলে, সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।  


) বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল 

ভারতের যেকোনো আদালতের  যেকোনো রায় , আদেশ ও দন্ডের  বিরুদ্ধে আপিল করার বিশেষ অনুমতি সুপ্রিমকোর্ট দিতে পারে ।


পরামর্শদান এলাকা


 সুপ্রিমকোর্টের প্রধান কাজ রাষ্ট্রপতিকে সাংবিধানিক পরামর্শ দেওয়া । রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন দেশে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিয়েছে তাহলে তিনি সেই প্রশ্নটিকে বিবেচনার জন্য সুপ্রিমকোর্টের কাছে পাঠাতে পারেন । 1992 সালে অযোধ্যা মসজিদ মন্দির বিতর্কে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চেয়ে ছিলেন।


নির্দেশ-আদেশ ও লেখ জারির এলাকা 


 নাগরিক অধিকার রক্ষা করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট 5 ধরনের আদেশ জারি করতে পারেন ।[32 নম্বর ধারা ] 1)বন্দী প্রত্যক্ষীকরণ ,2)পরমাদেশ ,3)প্রতিষেধ, 4)অধিকার পৃচ্ছা,  5) উৎপ্রেষণ


অন্যান্য ক্ষমতা 


ভারতের সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা । এই  আদালত যেকোনো বিষয়ে তদন্ত করতে পারে । বিভিন্ন সময়ে এই কোর্ট  আদালত অবমাননার শাস্তি দিয়েছে । সুপ্রিমকোর্টের রায়কে মান্য করা নিম্ন আদালতের পক্ষে বাধ্যতামূলক।


মূল্যায়ন


 ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ । যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এক নিরপেক্ষ ও স্বাধীন আদালতের ভূমিকা গ্রহণ করেছে । কেন্দ্র ও রাজ্যসরকার গুলির মধ্যে বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট তার দায়িত্ব পালন করে চলেছে নাগরিক অধিকার রক্ষা হলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি । সুপ্রিমকোর্ট গণতন্ত্রের রক্ষক ।  সুপ্রিমকোর্ট সম্পর্কে আহ্লাদী কৃষ্ণস্বামি আয়ার মন্তব্য করেছেন যে - "ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বিশ্বের যে কোনো দেশের সর্বোচ্চ আদালত অপেক্ষা অধিক ক্ষমতার অধিকারী" ।





                                https://politicalsciencenotesonline.blogspot.com



Post a Comment

Previous Post Next Post